চিচেন ইৎজা, মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপে অবস্থিত একটি প্রাচীন মায়ান সভ্যতার শহর, যা আজও তার
স্থাপত্য, বিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত।
এই স্থানটি বিশ্বের অন্যতম চমৎকার এবং রহস্যময় পুরাতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়, বিশেষ করে এখানে অবস্থিত এল কাসটিলো (পিরামিড অফ কুকুলকান) এর জন্য পিরামিডটি শুধুমাত্র মায়ান স্থাপত্যের একটি আইকনিক নিদর্শন নয়, এটি মায়ানদের জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণনা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীকও। এখন, প্রশ্ন হলো—চিচেন ইৎজার পিরামিডের ভেতরে কী রয়েছে? পিরামিডটির অভ্যন্তরের অনেকটা অংশ এখনও রহস্যে ঘেরা। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণা এবং খননকাজের মাধ্যমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং অনুমান উঠে এসেছে।
চিচেন ইৎজার পিরামিডটি মূলত একটি ধাপান্বিত পিরামিড (step pyramid) যা পিরামিডের গঠন দ্বারা প্রতীকীভাবে
পৃথিবী এবং আকাশের মধ্যে এক সেতু তৈরি করে। এটি কুকুলকান দেবতার প্রতি নিবেদিত, যার প্রতীক হল সাপ বা "ঝোলানো সাপ" মায়ানরা বিশ্বাস করত যে কুকুলকান দেবতা আকাশ এবং পৃথিবীর শক্তি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং এর মাধ্যমে তারা প্রকৃতি এবং পৃথিবীর চক্রগুলির সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারতেন।
এই পিরামিডটি ৯১টি ধাপ বা স্তরের সমন্বয়ে তৈরি, যা মোট ১৮৩টি ধাপের সাথে মিলিত হয়—এটি এক বছরে ৩৬৫ দিন পূর্ণ করার জন্য একটি গাণিতিক কাঠামো হিসেবে কাজ করে। এটি প্রমাণ করে যে মায়ানরা গণনা এবং সময় সংক্রান্ত জ্ঞানে অত্যন্ত দক্ষ ছিল।
এখনও পর্যন্ত, পিরামিডের ভেতর বিশেষ কোনো সমাধি বা ধনসম্পদ পাওয়া যায়নি। তবে বেশ কিছু ছোট কামরা
এবং অভ্যন্তরীণ কক্ষ রয়েছে, যেগুলো প্রাচীন মায়ান ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং রীতি-নীতির জন্য ব্যবহৃত হত বলে ধারণা
করা হয়।
- **এল কাসটিলো পিরামিডের অভ্যন্তরীণ কামরা:**
পিরামিডের ভিতরের একটি প্রধান কামরা আছে যা বেশ সোজাসুজি এবং একেবারে সাধারণভাবে তৈরি। এটি মূলত ধর্মীয় উপাসনার স্থান ছিল। বেশিরভাগ কামরা বর্তমানে খালি, তবে এখানকার দেয়ালে মায়ানদের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় উপাসনা সম্পর্কিত কিছু চিত্রকর্ম পাওয়া গেছে।
**এল কাসটিলোর অভ্যন্তরে একটি গোপন পথ:**
এটি একটি বিশেষ, সরু পথ যা পিরামিডের অভ্যন্তরে মাটির নিচে অবস্থিত। এই পথটি গোপনীয়তা এবং আধ্যাত্মিক
উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে এই পথটি সাধারণত পর্যটকদের জন্য বন্ধ থাকে এবং
এটি বিশেষ গবেষকদের জন্যই খোলা হয়।
মায়ানরা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে সূর্য এবং চাঁদের গতিবিধি গণনা করত। পিরামিডের ৯১টি ধাপ, যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে, সূর্য এবং চাঁদের সাথে সংযুক্ত একটি বিশেষ গণনামূলক কাঠামো তৈরি করেছে। এটি সঠিকভাবে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের সময়সূচী নির্ধারণ করতে সাহায্য করত, বিশেষত মায়ানদের ধর্মীয় উৎসব ও অনুষ্ঠানগুলির জন্য। যেহেতু পিরামিডটি একটি অত্যন্ত দক্ষ গণনা পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তৈরি, তাই এটি মায়ানদের জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ক্যালেন্ডার ব্যবস্থার উন্নতিকে তুলে ধরে।
পিরামিডটি শুধু একটি স্থাপত্যের নিদর্শন নয়, এটি মায়ানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু। কুকুলকান দেবতাকে কেন্দ্র করে প্রার্থনা এবং উৎসবের জন্য এই পিরামিড নির্মিত হয়েছিল। বিশেষ করে, প্রতি বছর শীতকালীন এবং গ্রীষ্মকালীন সূর্যাস্তের সময় পিরামিডের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের সিঁড়িতে সূর্যের আলো একটি সাপের আকৃতি ধারণ করে, যা মায়ানদের বিশ্বাস অনুযায়ী কুকুলকান দেবতার পৃথিবীতে আগমনকে চিহ্নিত করে। এই ঘটনাটি “সাপের পতন” নামে পরিচিত, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল।
পিরামিডের ভেতরের দেয়াল এবং কিছু অংশে মায়ানদের চিত্রকর্ম পাওয়া গেছে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং দেবতার চিত্র তুলে ধরে। এসব চিত্রকর্ম মায়ান সভ্যতার সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ইতিহাস সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য প্রদান করে। চিত্রগুলোতে দেবতার প্রতীক, জীবজন্তু, এবং আধ্যাত্মিক দৃশ্যগুলি তুলে ধরা হয়েছে, যা মায়ানদের শিল্প এবং কৃষ্টির এক অমূল্য অংশ।
পিরামিডটির অভ্যন্তরের অনেক কিছু এখনও রহস্যময় রয়ে গেছে। যদিও আধুনিক প্রযুক্তি এবং খনন কাজের মাধ্যমে অনেক কিছু বেরিয়ে এসেছে, তবুও এর অনেক অজানা দিক এখনো খুঁজে বের করা হয়নি। কিছু ঐতিহাসিকরা মনে করেন, পিরামিডের ভেতর এমন কিছু গোপন স্থান থাকতে পারে, যা প্রাচীন মায়ানদের হারানো তথ্য বা সভ্যতার গুপ্ত রত্ন ধারণ করে।
এছাড়া, পিরামিডের ভেতরে আরও কিছু এমন বিষয় থাকতে পারে, যা শুধুমাত্র ভবিষ্যত গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত হবে। এই স্থানটি নানা গবেষক, ঐতিহাসিক এবং বিজ্ঞানীদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, কারণ এটি প্রাচীন সভ্যতার নানা অজানা দিক উন্মোচন করতে পারে।
চিচেন ইৎজার পিরামিডের ভেতর কী রয়েছে, তা পুরোপুরি জানা সম্ভব নয়, তবে এই স্থাপত্যটির অভ্যন্তরে প্রাচীন মায়ান সভ্যতার অসাধারণ ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং গাণিতিক ধারণা লুকিয়ে রয়েছে। পিরামিডের নির্মাণ এবং তার অভ্যন্তরের স্থানগুলো শুধু মায়ানদের জ্ঞান এবং শিল্পের প্রতীক নয়, বরং পৃথিবী এবং আকাশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের নিদর্শনও। আজও এটি বিশ্ব ইতিহাস এবং সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আমাদের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।