এটা তো আমরা সকলেই জানি যে, আঁকার এবং ওজনের দিক থেকে পৃথিবীর বৃহত্তম স্তন্যপায়ী প্রাণী হলো নীল তিমি (Balaenoptera musculus)।
এই বিশাল সামুদ্রিক প্রাণীটির ওজন প্রায় ১৩৬ মেট্রিক টন (১৫০ টন) এবং এর দৈর্ঘ্য ৩০ মিটারের (৯৮ ফুট) বেশি পর্যন্ত হতে পারে।
এটি শুধু পৃথিবীর বৃহত্তম স্তন্যপায়ী প্রাণীই নয়, বরং এখন পর্যন্ত বাস করা বৃহত্তম প্রাণীও বটে। তবে সমুদ্রের পরিবেশে বৃদ্ধি পাওয়ার
শর্তভিত্তিক অবস্থা ভিন্ন। তাই স্থলভাগের সবচেয়ে বড় প্রাণী কে?
বর্তমানে, হাতিই এই খেতাবের অধিকারী। তবে অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই আরও বৃহত্তর কিছু প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল।
মেসোজোয়িক যুগে (প্রায় ২৫২ মিলিয়ন থেকে ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে) বেশ কিছু ডাইনোসর আধুনিক হাতি, জলহস্তী এবং গণ্ডারের চেয়েও বেশি দীর্ঘ ও বিশালকায় ছিল।
এই যুগের সবচেয়ে বড় ডাইনোসর ছিল সোরোপডরা—চার পায়ের বিশাল তৃণভোজী প্রাণীদের একটি গোষ্ঠী,
যাদের দীর্ঘ গলাবন্ধ এবং লম্বা লেজ ছিল। সোরোপডদের মধ্যেও সবচেয়ে বিশাল ছিল "টাইটানোসোরিয়া" নামক একটি উপগোষ্ঠী,
যেখানে সবচেয়ে বড় সোরোপডরা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
টাইটানোসোররা পৃথিবীর ক্রেটেশিয়াস যুগের শেষের দিকে (১৪৫ মিলিয়ন থেকে ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে) বাস করত, এবং তাদের জীবাশ্ম পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশেই পাওয়া গেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই বিশাল দানবেরা ক্রেটেশিয়াস যুগের শেষেই বিলুপ্ত হয়ে যায়।
নিচে বিভিন্ন আকারের আটটি টাইটানোসোর সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো।
এক বিশালাকায় টাইটানোসোর ড্রেডনোটাস ছিল অন্যতম বৃহত্তম টাইটানোসোর, এবং কিছু সূত্র মতে, এটি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় ডাইনোসরও হতে পারে। এর মোট দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ২৬ মিটার (প্রায় ৮৫ ফুট) এবং এর আনুমানিক ওজন ছিল ৫৯ মেট্রিক টন (প্রায় ৬৫ টন)। এই বিশাল ডাইনোসরের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে আর্জেন্টিনার দক্ষিণ প্যাটাগোনিয়ার প্রাচীন শিলা স্তর থেকে, যা প্রায় ৭৭ মিলিয়ন বছর আগের। ড্রেডনোটাসের একমাত্র পরিচিত প্রজাতি হলো D. schrani।
© image: Knowns-Era.com
পাটাগোটাইটান মাইওরাম সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ স্থলচর প্রাণী ছিল। এর জীবাশ্ম বিশ্লেষণের পর বিজ্ঞানীরা এর আকার সম্পর্কে ধারণা পান। আবিষ্কৃত হাড়ের সংগ্রহের মধ্যে একটি উরুর হাড় (থাইবোন) ছিল, যার দৈর্ঘ্য ছিল ২.৪ মিটার (৮ ফুট)। বিশাল আকৃতির কারণে ২০১৪ সালে প্রথম আবিষ্কারের পর থেকে ২০১৭ সালের আগস্টে আনুষ্ঠানিক নামকরণ হওয়ার আগ পর্যন্ত এটিকে শুধু "টাইটানোসর" হিসেবেই ডাকা হতো। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পাটাগোটাইটান মাইওরামের ওজন প্রায় ৭০ মেট্রিক টন (প্রায় ৭৭ টন) এবং দৈর্ঘ্য ৩৭.২ মিটার (১২২ ফুট) ছিল। তবে কিছু গবেষকের মতে, এই পরিমাপগুলো অতিরঞ্জিত হতে পারে। এই বিশাল দানবীয় ডাইনোসরটি আজ থেকে প্রায় ১০০ মিলিয়ন থেকে ৯৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে বসবাস করত।
© image: DeviantArt
আর্জেন্টিনোসরাস প্রথম বিজ্ঞানীদের নজরে আসে ১৯৯৩ সালে। তবে এর প্রথম নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৮৭ সালে, যখন আর্জেন্টিনার একটি খামারে একটি বিশাল জীবাশ্ম পাওয়া যায়, যা আকারে ছিল পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের সমান। খামারটির মালিক প্রথমে ভেবেছিলেন এটি বিশালাকৃতির কোনও জীবাশ্মকৃত কাঠের টুকরো। তবে ১৯৯৩ সালে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেন যে এটি আসলে একটি নতুন প্রজাতির সোরোপড ডাইনোসরের কশেরুকার অংশ। যদিও এখনো পর্যন্ত আর্জেন্টিনোসরাসের সম্পূর্ণ কঙ্কাল পাওয়া যায়নি, তবে বিভিন্ন জীবাশ্মের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে এর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৩৭ থেকে ৪০ মিটার (১২১ থেকে ১৩১ ফুট) এবং ওজন ছিল ৯০ থেকে ১০০ মেট্রিক টন (৯৯ থেকে ১১০ টন)। এসব পরিমাপ অনুসারে, আর্জেন্টিনোসরাস ছিল বিশ্বের ইতিহাসে আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় ডাইনোসর এবং বৃহত্তম স্থলচর প্রাণী।
© image: Wallpaper Flare
সাল্টাসরাস হলো একটি টাইটানোসৌর, যার নামকরণ করা হয়েছে আর্জেন্টিনার উত্তরাঞ্চলের সাল্টা শহরের নামে, যেখানে এর জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছিল। ১৯৮০ সালে প্রথম এই প্রজাতির বর্ণনা দেওয়া হয়। অন্যান্য টাইটানোসৌরদের তুলনায় এটি তুলনামূলকভাবে ছোট, যার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১২.২ থেকে ১২.৮ মিটার (প্রায় ৪০ থেকে ৪২ ফুট) এবং ওজন প্রায় ৭ মেট্রিক টনের সামান্য কম (প্রায় ৭.৭ টন)। অন্য অনেক টাইটানোসৌর তাদের বিশাল আকারের ওপর নির্ভর করেই শিকারিদের হাত থেকে রক্ষা পেত, তবে সাল্টাসরাসের অসম্পূর্ণ জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, এই প্রজাতি একটু ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করত। এর শরীরের উপরিভাগে ছিল অস্টিওডার্ম বা হাড়ের মতো শক্ত আবরণ, যা শিকারিদের দাঁতের আঘাত প্রতিহত করে এর দেহকে সুরক্ষিত রাখত।
© image: DeviantArt
১৯৯৮ সালে, মাদাগাস্কারের উত্তরের একটি পাহাড়ি ঢালে খননকার্য চালানোর সময় গবেষকরা একটি কিশোর রাপেটোসরাস ক্রাউসেই-এর জীবাশ্ম আবিষ্কার করেন। এই খননকার্যে পাওয়া গিয়েছিল টাইটানোসরের অন্যতম সম্পূর্ণ কঙ্কাল, যা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত কঙ্কালগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা। এছাড়াও, সেখানে একটি কিশোর রাপেটোসরাসের খুলি এবং এক পূর্ণবয়স্ক নমুনার খুলি পাওয়া গিয়েছিল। যদিও কিশোর রাপেটোসরাসের কঙ্কাল ছিল মাত্র ৮ মিটার (প্রায় ২৬ ফুট) লম্বা এবং কোনো পূর্ণবয়স্ক কঙ্কাল পাওয়া যায়নি, তবে জীবাশ্মবিদরা অনুমান করেন যে এই প্রজাতির পূর্ণবয়স্ক সদস্যরা প্রায় ১৫ মিটার (প্রায় ৪৯ ফুট) পর্যন্ত লম্বা হতে পারত। রাপেটোসরাসের হাড় পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে এটি প্রায় ৭ কোটি বছর আগের, অর্থাৎ পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ গণবিলুপ্তি, কেটি (K-T) বিলুপ্তির মাত্র ৪০ লক্ষ বছর আগের সময়কার।
© image: Wikimedia Commons
১৯৫৩ সালে ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরতলির প্রেসিডেন্টে প্রুদেন্তে গঠন থেকে একটি আংশিক কশেরুকা স্তম্ভ ও একটি পাঁজরের হাড় উদ্ধার করা হয়। এই জীবাশ্মগুলো ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে একটি জাদুঘরে সংরক্ষিত ছিল, কারণ ব্রাজিলের গবেষকদের সেগুলো বিশদভাবে বিশ্লেষণ করার মতো পর্যাপ্ত জনবল ও সম্পদ ছিল না। অবশেষে, ২০১৬ সালে গবেষকরা এই জীবাশ্মগুলো নতুন একটি টাইটানোসৌর প্রজাতির অংশ বলে ঘোষণা করেন, যা ব্রাজিলে আবিষ্কৃত মোট নয়টি টাইটানোসৌর প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বড়। এই জীবাশ্মগুলোর আকার থেকে অনুমান করা হয়, পূর্ণবয়স্ক অস্ট্রোপোসেইডন ম্যাগনিফিকাস প্রায় ২৫ মিটার (৮২ ফুট) দীর্ঘ ছিল। যেসব বালুকাশিলা ও কর্দম শিলাস্তর থেকে জীবাশ্মগুলো পাওয়া গেছে, তাদের বয়স বিশ্লেষণ করে গবেষকরা ধারণা করেন, এই বিশালকায় ডাইনোসরটি প্রায় ৮৪ মিলিয়ন থেকে ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে বিচরণ করত।
© image: Wikimedia Commons
প্যারালিটাইটান স্ট্রোমেরি প্রথমবারের মতো ২০০১ সালে বর্ণিত হয়, যখন মিসরের কায়রো শহর থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার (১৮৬ মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি খননস্থলে বিশাল এক ফসিল আবিষ্কৃত হয়। সেখানে ১.৬৯ মিটার (৫.৫ ফুট) লম্বা একটি উরুর হাড় (থাইবোন) পাওয়া যায়, পাশাপাশি খণ্ডিত কাঁধের হাড়, সামনের পায়ের হাড়, দাঁত ও কশেরুকার কিছু অংশও উদ্ধার করা হয়। এত বড় একটি উরুর হাড়ের সন্ধান পাওয়ার ফলে অনেক জীবাশ্মবিদ মনে করেন যে, প্যারালিটাইটানের আকার আর্জেন্টিনোসরাসের সমকক্ষ হতে পারে। এই টাইটানোসরের দৈর্ঘ্য ও ওজন নিয়ে বিভিন্ন অনুমান রয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ৩০.৫ মিটার (৮২ থেকে ১০০ ফুট) এবং ওজন ৬০ থেকে ৭৫ মেট্রিক টন (প্রায় ৬৬ থেকে ৮৩ টন) হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। প্যারালিটাইটান আজ থেকে প্রায় ৯৪ মিলিয়ন বছর আগে ক্রেটাশিয়াস যুগের মাঝামাঝি সময়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্যে বিচরণ করত।
© image: Wikimedia Commons
.৮ **শিংগোপানা সঙ্গওয়েনসিস**
শিংগোপানা সঙ্গওয়েনসিস, তানজানিয়ার এক বিরল টাইটানোসৌর, প্রথমবারের মতো ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে বর্ণিত হয়। এর জীবাশ্মগুলোর মধ্যে ছিল মেরুদণ্ডের কশেরুকা, পাঁজরের হাড়, সামনের পায়ের একটি হাড়, ভাঙা নিম্ন চোয়াল এবং শ্রোণি-অস্থির কিছু অংশ। ২০০২ সালে আফ্রিকার গ্রেট রিফট ভ্যালির গালুলা গঠনে (বর্তমান দক্ষিণ-পশ্চিম তানজানিয়ায়) এই জীবাশ্মগুলো আবিষ্কৃত হয়। জীবাশ্মটি যে শিলার মধ্যে পাওয়া গেছে, তার বয়স আনুমানিক ১০ থেকে ৭ কোটি বছর। "শিংগোপানা" শব্দটি সোয়াহিলি ভাষায় "প্রশস্ত গলা" বোঝায়, এবং এই নামটি দেওয়া হয়েছিল ডাইনোসরটির স্ফীত গ্রীবার কশেরুকার জন্য। দৈর্ঘ্যে মাত্র ৮ মিটার (প্রায় ২৬ ফুট) এবং ওজনে আনুমানিক ৫ মেট্রিক টন (প্রায় ৫.৫ টন), শিংগোপানা সঙ্গওয়েনসিস ছিল টাইটানোসৌরদের মধ্যে অন্যতম ক্ষুদ্রতম প্রজাতি।